BanglaData.Blogspot.Com

BanglaData.Blogspot.Com

সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৫

মৃগী রোগের নানা তথ্য

মৃগী রোগের নানা তথ্য

বিশ্বে মৃগী রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন, যার অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী। ডঐঙ -এর মতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ২ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত্য হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেড়্গাপটে মৃগী একটি পরিচিত রোগ। প্রতি ২০০ জনের মধ্যে ১ জন এতে আক্রান্ত্য হতে পারে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যদি একটি শহরের জনসংখ্যা ৫০,০০০ হয় তবে সেখানে প্রতিবছর ২৫ জন নতুন মৃগী রোগী দেখা যায়, জ্বরের সময় খিঁচুনিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ জন, সারাজীবনে অন্ত্যতঃ
একবার খিঁচুনিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১০০ জন এবং প্রকৃত মৃগী রোগী পাওয়া যায় ২৫০ জন। এই রোগীদের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগের বয়স ১৫ বছরের নিচে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে মৃগী রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যথায় এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
মৃগী সম্পর্কে ভ্রান্ত্য ধারণাগুলি ঝেড়ে ফেলুন
এক সময় মৃগীরোগকে ভাবা হতো আধ্যাত্মিক শক্তির এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বে মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীদের মৃগীরোগ ছিল বলে ইতিহাসে প্রথম তথ্য পাওয়া যায়। তখন এই রোগকে “
;পতন রোগ” বা ” ঞযব ভধষষরহম ফরংবধংব” বলা হতো। এক সময় ভাবা হতো মৃগীরোগ অসাধারণ ড়্গমতাশীল ব্যক্তিদেরই কেবল হয়। আবার অশুভ আত্মা ভর করার কারণে এই রোগ হয় বলেও ভাবা হতো।
মৃগী সম্পর্কে ভ্রান্তô ধারণা আজও রয়ে গেছে। আমাদের দেশে গ্রাম-গঞ্জে এমনকি শহরেও অনেকেই মনে করে মৃগীরোগ এক ধরনের অভিশাপ। আবার মৃগীরোগকে জ্বীন বা ভূতের আছর ভেবে থাকে অনেকে এবং রোগীর উপর চিকিৎসার নামে ঝাড়-ফুঁকসহ বিভিন্ন অপ-চিকিৎসায় শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার চালায়। ফলে রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে, তখন সঠিক চিকিৎসাতেও ভাল ফল পাওয়া যায় না। এছাড়া অনেক রোগীর অভিভাবক লোকলজ্জার ভয়ে তাদের সন্ত্যানের রোগ গোপন করে। অথচ চিকিৎসার মাধ্যমে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ রোগী সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারে।
মৃগীরোগ কি?
মৃগী মস্তিষ্ড়্গের স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতাজনিত একটি রোগ। সুস্থ স্বাভাবিক একজন লোক যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপুনি অথবা খিঁচুনির শিকার হয়, চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলে কিংবা কোন শিশুর চোখের পাতা স্থির হয়ে যায়, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অথবা মানসিকভাবে সুস্থ কোন লোক অস্বাভাবিক আচরণ শুরম্ন করেতৈবে তাকে মৃগী রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এসব অস্বাভাবিকতা মস্তিষ্ড়্গের অতি সংবেদনশীলতার কারণে হয়ে থাকে।
মৃগীরোগের কারণঃ
মানবদেহের সমস্ত্য কার্যাবলী পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিôষ্ড়্গের স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে। কোন কারণে মানবদেহের কার্য পরিচালনাকারী মস্তিষ্ড়্গের স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক এবং নিবৃত্তিকারক অংশদ্বয়ের কার্যপ্রণালীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মৃগীরোগের লড়্গণ দেখা দিতে পারে। মস্তিôষ্ড়্গের অতি-
সংবেদনশীলতা ছাড়াও ব্রেন টিউমার, স্ট্রোক, মাথায় আঘাত ও রক্তপাত, রক্তশিরায় সমস্যা, ব্রেনের পুরনো ড়্গত, ইনফেকশন, মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, আলঝেইমার, নেশাজাতীয় ওষুধ সেবন, শরীরের লবণ, ভিটামিন বা খনিজ হ্রাস পাওয়া এবং ডায়াবেটিস থেকেও মৃগীরোগ দেখা দিতে পারে।
মৃগীরোগ কি একটি বংশানুক্রমিক রোগ?
বংশানুক্রমেও মৃগীরোগ দেখা দিতে পারে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জনে ২ জন মৃগীরোগে আক্রান্ত্য হয়Ìৈসড়্গেত্রে শুধুমাত্র বাবার দিক থেকে শিশুর মৃগীরোগে আক্রান্ত্য হওয়ার সম্ভাবনা
স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি, আর শুধু মায়ের দিক থেকে শিশুর এই রোগে আক্রান্ত্য হওয়ার সম্ভাবনা
শতকরা ৫ ভাগেরও কম। বাবা-মা উভয়েরই মৃগীরোগ থাকলে এই সম্ভাবনার হার কিছুটা বাড়লেও এটা
বলা যায় না যে, মৃগীরোগ একটি বংশানুক্রমিক রোগ। অনেক সময় বাবা-মা কারও এই রোগ নেই, কিন্তু
জন্মের সময় ত্রম্নটিযুক্ত মস্তিôষ্ড়্গের গঠনের কারণেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে শিশু কিংবা শিশু গর্ভে ধারণ করা অবস্থায় মা মৃগীতে আক্রান্ত্য হলে, শিশুর জন্মের প্রথম মাসে খিঁচুনি দেখা দিলে বা মস্তিôষ্ড়্গে আঘাত লাগলে কিংবা অক্সিজেনের ঘাটতি হলে শিশুর মৃগীরোগ দেখা দিতে পারে।
মৃগীরোগের লড়্গণসমূহঃ
একজন মৃগী রোগীর মধ্যে নিম্নের যে কোন একটি বা একাধিক লড়্গণ পরিলড়্গিত হতে পারেঃ
শৈরীর শক্ত হয়ে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাওয়া
হৈঠাৎ নমনীয়ভাবে ঢলে পড়া
হৈঠাৎ শরীরের কোন অংশে খিঁচুনি শুরম্ন হওয়া ও পর্যায়ক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া
Ìৈছাট বাচ্চাদের শরীর হঠাৎ ঝাঁকি খাওয়া
ঘৈন ঘন কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া
হৈঠাৎ মাথা বা পিঠ কিংবা পুরো শরীর সামনে ঝুঁকে আসা
হৈাত থেকে হঠাৎ করে কোন কিছু ছিটকে পড়া
হৈঠাৎ করে অস্বাভাবিক আচরণ শুরম্ন করা এবং হাত, পা এবং মুখের অস্বাভাবিক নাড়াচাড়া শুরম্ন হওয়া
শৈরীরের কোন স্থানে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া
উলেস্নখ্য যে, এই রোগের লড়্গণগুলি অন্য কোন কারণেও প্রকাশ পেতে পারে। তবে মৃগীরোগের ড়্গেত্রে সব সময় এইসব লড়্গণ প্রকাশ পায় বলে এগুলি কোন ব্যক্তির মাঝে নিয়মিতভাবে দেখা দিলে তাকে আমরা
মৃগীরোগী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
খিঁচুনি হলে করণীয়ঃ
মৃগীরোগ এমন একটি রোগ যা হঠাৎ করে যে কোনও পরিস্থিতিতে রোগীকে আক্রমণ করে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়। যার ফলে এই রোগে আক্রান্ত্যদের জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি। আর এই ঝুঁকি কমাতেই একদিকে যেমন রোগীর জীবনযাত্রাগত কিছু পরিবর্তন আবশ্যক, সেই সাথে পারিপার্শ্বিক মানুষদেরও করণীয় রয়েছে অনেক কিছু। সাধারণতঃ খিঁচুনি শুরম্ন হবার পর নিজ থেকেই থেমে যায়। খিঁচুনি হলে সেটি থামানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ রোগীর জন্য ড়্গতির কারণ হতে পারে। এর ফলে তার মাংসপেশী ছিঁড়ে যাওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। খিঁচুনির সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল
রাখা প্রয়োজনঃ
Ìৈরাগীকে আগুন, পানি, ধারালো অস্ত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি থেকে দূরে রাখতে হবে
Ìৈচায়াল বন্ধ হয়ে গেলে জোরপূর্বক খোলার চেষ্টা করা উচিত নয়।
কারও মৃগী হলে করণীয়ঃ
Ìৈরাগীর মুখে চামড়ার জুতো, গরম্নর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরা উচিত নয়। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ড়্গতি বেশি হয়।
মৈৃগী হঠাৎ শুরম্ন হয়ে নিজ থেকেই থেমে যায়। এজন্য বাড়তি কিছু যেমনঃ মাথায় পানি দেয়া, হাত-পা চেপে ধরা, ওষুধ খাওয়ানোএৈসবের কোন প্রয়োজন নেই।
Ìৈরাগীকে নিজের মতো ছেড়ে দিতে হবে।
Ìৈরাগীর আশেপাশে যেন ধারালো যন্ত্রপাতি, অস্ত্র বা আগুন, ইট-পাথর না থাকে সেদিকে লড়্গ্য রাখতে হবে। কারণ, এসবের কারণে সে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
Ìৈরাগী রাস্তôায় থাকলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে।
xৈখঁচুনির স্থায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখুন।
Ìৈকৗতূহলী জনতাকে দূরে রাখুন।
Ìৈরাগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তাকে সাহায্য করম্নন এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করম্নন।
এছাড়া রোগীকেও সব সময় সাবধান থাকতে হবে যেন মৃগীতে আক্রান্তô হলে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে।
এজন্য সব সময় নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সম্বলিত পরিচয়পত্র সাথে রাখতে হবে, যানবাহনে কিংবা রাস্ত্যাঘাটে চলাচলে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবেসৈবচেয়ে বড় কথা সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
কখন চিকিৎসার প্রয়োজন?
মৃগীরোগের লড়্গণগুলো প্রথমবারের মতো দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
কারণ কোন ধরনের মৃগীতে রোগী আক্রান্তô বা আদৌ মৃগীরোগ না অন্য কোনও সমস্যা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়েই চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা প্রদান করেন। নিচে উলেস্নখ করা হলো কখন মৃগী রোগীকে
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবেঃ
যৈদি খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়
যৈদি শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়
যৈদি রোগী একনাগাড়ে অনেকড়্গণ ধরে বিভ্রান্ত্য হয়ে থাকে কিংবা অচেতন থাকে

যৈদি খিঁচুনির সময়ে রোগী কোনওভাবে আহত হয়

যৈদি রোগী প্রথমবারের মতো মৃগীতে আক্রান্ত্য হয়

বিস্ত্যারিত জানার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালের নিউরোলজী বিভাগে যোগাযোগ করম্নন।
শেষ কথা
মৃগীরোগ নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্ড়্গার ও ভ্রান্ত্য ধারণার বিরম্নদ্ধে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাবিদ আত্রেয় এবং পরবর্তীতে প্রাচীন গ্রীসের হিপোক্রেটাস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সেই সময়েই তারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, মৃগী আসলে একটি মস্তিôষ্ড়্গের রোগ, অন্য কিছু নয়।
তারপরও এই রোগের কুসংস্ড়্গারমূলক বিশ্বাসগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মাঝে রয়ে গেছে।
এমনকি আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতেও একজন মৃগী রোগীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয় যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মৃগী যে কোন সাধারণ রোগের মতই একটি রোগ এবং এই রোগীদের প্রতি আমাদের সহযোগী মনোভাবাপন্ন হওয়া উচিত। সমস্তô ভ্রান্ত্য ধারণা এবং কুসংস্ড়্গার ত্যাগ করে মৃগীরোগীকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

**********************************
লেখকঃ কায়েদ-উয-জামান
সহকারী অধ্যাপক, জীববিজ্ঞান বিভাগ
শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ, জামালপুর।
উৎসঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ নভেম্বর ২০০৭

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন